রাত আড়াইটা।
রাস্তায় একটা সাদা কুকুর কিছুক্ষণ পরপরই ডেকে উঠছে, আর তখন ওর পিছনে থাকা কালো কুকুরটাও এদিক ওদিক সবদিক দৌড়ে তারস্বরে চিৎকার করছে।
একটানা অনেকদিন শরীর খারাপ থাকায় সূর্যের আলো গায়ে মাখার সুযোগ হয়নি, তাই আজ চাঁদের আলোতে স্নান করে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছি।
আমাকে দেখে মনে হয় সাদা কুকুরটার পছন্দ হয় নি। তাই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
কুকুরদের ভাষা আমার জানা নেই, তবে আমার মনে হয় কুকুরটা আমার পরিচয় জানতে চেয়ে চিৎকার করছে। এখনো হয়তো বুঝে উঠতে পারছে নাহ আমি চোর না সাধু কোন গোছের। দাঁতমুখ খিঁচানোর হয়তো সেটাই কারন। সারমেয় ভাষাতে হয়তো বুঝিয়ে দিতে চাইছে এ এলাকাতে তাঁর উপর দাদাগিরি চলবে নাহ। পৈতৃক সূত্রে এলাকার নেতা না হলেও সে যে নিজেকে এই এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি ভাবে সেটা তাঁর হাবেভাবে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। অন্তত যাতে তাঁকে অনুসরণ করা কালো কুকুরটা আর তাঁর পেছনের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরগুলোকে তো তাঁর বুঝানো দরকার তাঁর ক্ষমতার ব্যপ্তি কত বিশাল পরিমাণের।
বাঘে ছুলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে বত্রিশ ঘা। সুন্দরবনের সব বাঘ এখন চিড়িয়াখানার খাঁচায়, না হলে ধানমন্ডি ২ এর নেতা খ্যাতা টাইপ লোকদের বাসাতে সোফার শোভাবর্ধন করছে। একবার খাঁচার ভেতরে থাকা এক বাঘকে মানুষের মাথা লাগিয়ে দাঁড়ি মোচসহ বিড়ি ফুঁকতে দেখেছিলাম। সময় তখন বর্ষাকাল, দর্শনার্থীর আনা গোনা ছিল নাহ, এরকম নির্জন অবস্থায় হঠাত আমাকে দেখতে পেয়ে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল। আমি খাঁচার বাইরে থাকলেও ঝেড়ে দৌড় লাগাই, কে জানে আমার কাছে যদি গাজার স্টিক আবদার করে বসে, তখন? তাই বাঘের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বাদ, বাবা পুলিশে চাকরি করে অবসর নিয়েছিলেন, তাই পুলিশের সাথেও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বাদ। তারপরও কোন নতুন কনস্টেবল হঠাত থানায় ধরে নিয়ে গেলে সেখান থেকে কিভাবে যেন ১০ মিনিটের ভেতর ছাড়া পেয়ে যাই। দুই তিনজনের ব্যাপারে ধারণা করতে পারি আমাকে ছাড়ার পেছনে ভূমিকা রাখার, কিন্তু কাজটা আসলে কে করে সে ব্যাপারে সঠিক অনুমান কখনো করে উঠতে পারি নি।
বাঘ, পুলিশ বাদ। দাঁড়িয়ে আছি কয়েকটা চ্যালা নিয়ে ঘিরে দাঁড়ানো নেতা টাইপ কুকুরটার সাথে। আমাকে সে তাঁর নিজস্ব ভাষাতে প্রশ্ন করেছে, উত্তর দিতে না পারলে আমাকে কামড়ে দেবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আচ্ছা, কুকুরে ছুলে কত ঘা?
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমিও বার কতক সারমেয় ভাষার মত করে ঘেউ ঘেউ করে উঠলাম। উত্তর সঠিক হয়েছে কিনা জানি নাহ, তবে সাদা কুকুরটাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কালো কুকুরসহ বাকি কুকুরগুলো সরে যেয়ে রাস্তা করে দিল হাঁটার। এই সুযোগ ঝটপট কেটে পড়ার, কেটে পড়ছিও প্রায়, এমন সময় আবার সেই কলিজা ঠান্ডা করা সারমেয় ধ্বনি।
দৌড় দেবার কথা মনে আসল একবার, কিন্তু সাথে সাথেই সেটা বাতিল করে দিলাম। এদের মনস্তত্ত্ব অনেকটা সাধারণ পাবলিকের মত। যাদের ধমক দিলে কুই কুই করে ওঠে, যেন এখুনি কেঁদে দিবে। কিন্তু যেই একবার বুঝবে আপনি চিপাতে, তখন মারা দিতে দিতে একেবারে ভরে দিবে।
মেজাজ খুব গরম হয়ে গেল, কিছু না বলে সিম্পল 'ইগনোর কর' নীতিতে হেঁটে যেতে থাকলাম। অন্য কুকুরগুলো একটা হেভিওয়েট চিৎকার যুদ্ধ দেখার জন্য অনেক আগ্রহ নিয়ে ওয়েট করলেও আমার রণে ক্ষণ দেয়া দেখে খুবই আশাহত হলো মনে হয়।
রোজার মাস, মুখের চুল দাঁড়ি শেভ না করায় আর প্রতিদিনের দাঁত ব্রাশটা আজ না কাল করে গড়িমসি করাতে চেহারা দেখে যে কারো মনে করার কথা আফ্রিকা থেকে আমার আগমন ঘটেছে। দিনের বেলা রাস্তায় বের হলে হঠাত করে কোন বাংগালীর মুখে সোহাহিলি বা বাওয়ালি ভাষার অভিবাদনও শুনে বসতে পারি। রোজার ঠিক আগে হাত কাঁটাটা খুব ভালোই ভোগাল এ কয়দিন। এখন হাতে ফাঁক হয়ে যাওয়া চামড়া জোড়া লেগে গেলেও খুব বড় একটা কাটা দাগের অস্তিত্ব ঠিকই রয়ে গেছে, মাঝে মাঝে হাতে টানও অনুভব করি।
কুকুরগুলো এখন ঠিক আমার পেছন পেছন দলবদ্ধ হয়ে হাঁটছে, সাদা কুকুরটা, তাঁর পেছনে কালো কুকুরটা, তাঁর পেছনে তাদের বাকি চ্যালা চামুন্ডারা। রাস্তাতে এখনো কিছু লোকের হালকা পাতলা আনাগোনা থাকায় তাঁরা এ দৃশ্য দেখে অবাক ও নির্বাক। আমি কোন প্রকার ভাবভংগির ধার না ধেরে চুপচাপ হেঁটে চলছি, পেছনে সারমেয়কুল। মাঝে এক হুজুর গোছের দাড়িওয়ালা টাইপ লোককে দেখে সাদা কুকুরটা চাঁপা গলাতে ঘড় ঘড় করে উঠল, হুজুর তৎক্ষণাৎ বাড়ির ভেতরে ঢুকে পগারপাড়।
কোন দিকেই কোন খেয়াল না রেখে কোন বিশাল ভাবুকের মত হাঁটছি, সংগে একপাল কুকুর।
এ ক'দিন বাসাতে বসে থাকাকালীন অবসরের সময় কাঁটাতে যখন ফেসবুকে লেখালেখি নিয়মিত করলাম, তখন এক মেয়ের সাথে পরিচয়।
একদিন হঠাত ফোনে আননোন নাম্বার হতে কল আসল, আমি আবার আননোন নাম্বার হতে আসা কলগুলো খুব আগ্রহের সাথে ধরি। একবার এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা তাঁর ছেলেকে ফোন দিতে যেয়ে আমাকে ভূলে ফোন দিয়েই শুরু করে দিয়েছেন, 'কালামানিক, বাবা আমার, সোনা আমার, কেমন আছোস তুই?'
আমিও তখন গলাতে খুব আবেগ ঢেলে জবাব দেই, 'মুই খুব ভালা আছুইন মা। তুই কিবা আছুত?'
আমার গলার স্বরে বা কাঁচা অভিনয়ে এক সময় তিনি যখন বুঝতে পারেন আমি তাঁর কালো মানিক বা ফুটবলার পেলে কোনটাই নাহ, তখন অভিসম্পাত করতে করতে ফোনটা কাটেন, আর আমি বেডে শুয়ে জানালার ওপাশটা ভালোমত দেখার চেষ্টা করি।
কিছুক্ষণ পর পুনরায় মহিলাটির ফোনকল ঠিকই আসে, তবে এবার সেখানে না থাকে আবেগ না থাকে রুক্ষতা। কাঁদ কাঁদ স্বরে বেদনার্ত গলায় আমাকে তিনি জানান, তাঁর পেলে নাকি এখন সত্যিই প্লেয়ার হয়ে গেছে। মার প্রতি তাঁর এখন আর কোন অনুভূতি কাজ করে নাহ, তাঁকে নাকি ইচ্ছামত গাল পেরে আর কখনো ফোন না করার ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে সে। মহিলা তখন আমার কাছ থেকে পাওয়া আবেগময় কথার সাথে তাঁর ছেলের কথার তুলনা করে আর হাহাকার করেন শুধু। আমি তখন কিছু না বলে চুপ করে ফোনটা কেটে দেই, কিছু কিছু সময় থাকে, যখন শান্তনার চেয়ে কেঁদে বুক ভাসালেই কষ্ট বেশি লাঘব হয়।
যথারীতি তাই সেদিনও ফোনটা রিসিভ করি, ওপাশ থেকে হ্যালো শুনতেই কিছুটা নিরাশ হলাম। মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চা মেয়ে খিল খিল করে হাসছে আর কথা বলছে।
- অ্যাই তুমি নীল?
- না, আমি ব্লু। কি চাই?
- হিহিহি, তোমার পাঞ্জাবীতে পকেট আছে?
- না, তবে প্যান্টে পকেট আছে, রেডিমেড প্যান্ট, পকেট থাকেই।
- তাইলে তুমি কিসের হিমু হইলা? হিমুদের তো পকেট থাকে নাহ।
- হলুদ হিমু হওয়া সহজ, কিন্তু নীল হিমু হওয়া কঠিন দেখে কেউ হতে চায় নাহ, কিন্তু আমি নীল হিমু।
- তাই নাকি? আচ্ছা, আমি যদি নীল হিমুর নীলিমা হতে চাই তাহলে কি করতে হবে আমায়?
- আপাতত বসে বসে মুড়ি খেলেই চলবে। আজান দিয়েছে, ইফতারী করছি, তুমিও করো।
- খাইছে, নেশাখোরদের যে ধর্মভীতি থাকে সেটা জানা ছিল নাহ।
- আজব, ধর্মভীতি আসবে কই থেকে, নেশাখোরদের রোজা রাখতে নিষেধ আছে নাকি?
- না তা নেই, কিন্তু আমার জানামতে নেশাখোর ছেলেদের ধর্মের প্রতি কোন আগ্রহ, ভয় কোনটাই থাকে নাহ।
- আমারও খুব একটা যে আগ্রহ বা ভয় আছে ধর্মের প্রতি তা নাহ। এটার আগমন মূলত বিশ্বাসের উপর থেকে।
- সে সাথে ভয়ও।
- ধর্মে ভয় দেখিয়ে ছাগল খেদানোর মত করে বোকাদের ধর্ম পালন করতে বাধ্য করা হয়, আর যার বুদ্ধিমান তাঁরা ধর্মটাকে আঁকড়ে ধরেন মূলত বিশ্বাসের উপর থেকে।
- ধূর তোমার সাথে কথায় পারা যাবে নাহ। শোন, এতকিছু বুঝি নাহ, এখন থেকে আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড। আমি যেটা বলব সেটাই সত্য বলে মেনে নিবা, না হলে চিমটি খাবা। আমার রাগ হলে রাগ ভাংগাবা, না হলে চিমটি খাবা। আমায় কাঁদালে চিমটি খাবা, বুঝতে পারছ?
- হু, বুঝছি, এখন থেকে ভাত না খেলেও চলবে আমার, তোমার চিমটি খেতে খেতেই পেট ভরে যাবে আমার।
- কি বললা? জোরে বলো, শুনি নাই।
- কিছু নাহ, আচ্ছা রাখছি এখন, পরে কথা হবে।
মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। ওর নামটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি, পরে একসময় জেনে নিতে হবে।
রাস্তায় কুকুরগুলো এখনো পিছু পিছু আসছে, আমিও হেঁটে চলেছি, উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন।
সিগারেট খাবার জন্য খুব মন খুব আনচান করলেও কোন চায়ের দোকান খোলা পেলাম নাহ। হয়তো রোজার মাস বলেই দোকানগুলি বন্ধ।
এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সাথে সাইকেল, সেটায় একটা ছোটখাট ব্যাগের মত কি যেন।
তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম, 'ভাই সিগারেট কই পাওয়া যায়?'
'কি সিগারেট?'
'গোল্ড লীফ, দুইটা হলেই হয়। আছে?'
সে তাঁর ব্যাগ হতে একটা লীফের প্যাকেট হতে দুটো গোল্ড লীফ বের করে দিল।
খুব খুশি মনে ব্যাটাকে বিশ টাকার একটা নোট দিতে সেটা নিজের পকেটে চালান করে দিল। বাকী দেবার কোন নাম গন্ধ নাই।
চাইতেই সে বলল, 'ভাই রাতের রেট এটা। আর লাগবে আপনার?'
আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম, পথে টহলরত এক পুলিশের গাড়ির সামনে পড়ে গেলাম।
- বাসা কই?
- যেখান থেকে আসছি।
- যান কই?
- বিড়ি খাইতে।
- ঐ রশিদ, এই হালারে একটু চেক কর তো, কথার ভাবভংগি ভালা লাগতেছে নাহ।
- চেক করার কি আছে, আমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে কিনা সেটা চেক করতে চাইছেন? শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন? আছে রে ভাই আছে, আমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে।
- আবে হালা কস কি? ঐ রশিদ ধর হালারে, নগদে হ্যান্ডকাফ লাগা, ঐ আবুল গাড়ি স্টার্ট দে।
- স্যার, হাতকড়া লাগানো লাগানো লাগবে নাহ, আমি নিজেই আপনাদের সাথে যাচ্ছি।
জেরারত দারোগাটি বিভ্রান্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কি করবেন বুঝতে পারছেন নাহ, আমি নিজে গাড়ীর ভেতরে উঠার সাথে সাথে আমাকে অনুসরণ করে গাড়ীতে উঠে বসলেন চুপচাপ।
থানায় পৌঁছার পরপরই ওসির রুমে তলব পড়ল আমার। ওসির গায়ে পুলিশের শার্ট, কিন্তু পড়নে লুংগি।
শার্টের ব্যাজে আক্কাস বি মাইনাস লেখা, কথাটার অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম নাহ।
মানুষ এখন পরীক্ষাতে এ প্লাস পেলেও সেটা কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করে নাহ, এ প্লাস এতটাই সস্তা।
সেখানে এই লোক ব্যাজে নামের পাশে বি মাইনাস ঝুলিয়ে রেখেছে কোন আক্কেলে? সে সারজীবন পরীক্ষাতে বি মাইনাস পেয়েও এখন থানার ওসি এটা মানুষকে দেখাতে? মাথায় তাঁর টাক চকচক না করলেও সেখানে চুলের অভাব দেখতে পাচ্ছি। যেসব ওসির মাথায় চুল কম থাকে, তাঁরা ভীষণ বদরাগী হয়ে থাকে শুনেছি। আক্কাস সাহেবের মুখে আক্কাস বিড়ি না থাকলেও একটা গোল্ড লীফ সাঁই সাঁই করে জ্বলছে। বিড়ির সাথে সাথে তাঁর মুখে একটা হাসির ধারাও দেখতে পাচ্ছি। মনে হয় এই লোক সবসময় মুখে হাসি ধরে রাখা টাইপ পাবলিক। দেখা গেল কেউ এসে তাঁকে জানাল যে তাঁর ছেলে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, তখন তিনি মুখের হাসি হাসি ভাবটা ধরে রেখেই হয়ত তাঁর স্ত্রীকে বলবেন, 'এই শোন, খোকা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমি বের হয়েছি, তুমি কোন চিন্তা করো নাহ কেমন?' অন্যদিকে কর্তব্যরত অধস্তনকে ডেকে হাসি হাসি মুখে বলবেন, 'রফিক সাহেব, ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমি একটু বের হলাম, আপনি এদিকটা দেখে রাখবেন।' রফিক সাহেবের মাথায় কথাগুলো পুরোপুরি কাজ করার পূর্বেই হয়ত তিনি বের হয়ে গেছেন ততক্ষণে।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি সিগারেটের ফাঁক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো মুখে হাসি হাসি ভাবটা বহাল আছে,
- নাম?
- নীল।
- কি কর?
- পড়ি আর হাঁটি।
- এই দুইটা কাজ একসাথে করা যায় নাকি?
- জি স্যার, ট্রাই করে দেখবেন একবার, খুব বেশি মজা পাবেন পড়ে।
- হুম, কি কারনে থানায় আনা হইছে তোমাকে?
- কেন স্যার, কারন ছাড়া এখানে আসা কি বাড়ন?
- প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে কর কেন?
- আপনি এমন প্রশ্ন করতেছেন যা তাঁর উত্তর প্রশ্ন দিয়েই সঠিকভাবে দেয়া যায়।
-হুম, চা, বিড়ি, গাজা, অভ্যাস আছে?
- অভ্যাস না থাকলেও অনভ্যস্ত নই, তবে রোজার মাস বলে শুধু চা আর সিগারেটেই চলবে আমার।
- আচ্ছা, তুমি বসো আমি আসতেছি একটু।
আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়েই পাশের রুমে যেয়ে আমাকে যিনি ধরেছিলেন, সেই দারোগাকে ডাক দিলেন তিনি।
তাঁর সাথে কতক্ষণ চাঁপাস্বরে কথা বলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ তর্জন গর্জন করে চললেন, অতঃপর ফিরে আসলেন ধীরে ধীরে।
- তোমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই স্বীকার করতে গেলে কেন?
নাও তো করতে পারতে।
- মিথ্যা বলা আমার স্বভাবে নেই।
- ও আচ্ছা, তা শুনি তোমার যন্ত্রপাতির বিবরণ।
- স্যার কি সত্যিই শুনতে আগ্রহী?
- হ্যাঁ, বলতে থাকো।
- এটি দেখতে ঘন কালো, আপনি রয়েল ব্ল্যাক বলেও অভিহিত করতে পারেন। আশেপাশে কখনো চুল থাকে, কখনো থাকে নাহ। খুবই স্পর্শকাতর, তাঁর মানে এই নাহ যে স্পর্শে কাতুকুতু লাগার মত অনুভূতি হয়, বরং তখন সগর্জনে রেগে মেগে ফুঁসে ওঠে।
- হয়েছে হয়েছে থাক আর বলতে হবে নাহ। ফাজিল পোলা, ফাইজলামী করো পুলিশের সাথে? কানের নিচে একটা বয়রা খাইলে পুরা সিধা হয়ে যাবা বজ্জাত ছেলে কোথাকার।
- স্যার, আপনার আগের ওসিও একই কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে পোস্টিং নিয়ে নিজ ইচ্ছাতে বান্দরবান চলে গিয়েছিলেন।
- তবে রে হারামজাদা।
হাসি হাসি মুখটা হঠাত করে বদলে গেল, টেবিলের উপর হতে লাফিয়ে আমাকে চড়ানোর একটা প্রবণতা দেখা গেল আক্কাস সাহেবের ভেতর। ঠিক তখনই একটা ফোন আসল ওসি সাহেবের অফিশিয়াল টেলিফোনে।
ফোনটা বেজেই চলছে ক্রমাগত। আমাকে চড়াবেন নাকি ফোনটা ধরবেন সেটা নিয়ে কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্ত তিনি। সময় খুব খারাপ যাচ্ছে, কার না কার ফোন সেটা না ধরে কোন অহেতুক ভোগান্তিতে হয়তো পড়তে চান নাহ।
তাঁকে দ্বিধা হতে মুক্তি দিতে বলে উঠলাম, 'স্যার ফোনটা ধরুন, হয়তো আপনার ছেলের রক্তের গ্রুপের সাথে ম্যাচ করে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেছে।'
কথাটা শোনার সাথে সাথেই চমকে উঠলেন তিনি, টেলিফোনটা উঠালেন, তাঁকে শুধু হ্যালো বলতে শুনলাম, এরপর কতক্ষণ তিনি হু হা করে গেলেন। ডায়ালটা নামানোর পর শুধু অস্ফুটে গলাতে এটুকুই বলতে শুনলাম, 'ফাক।'
আমার দিকে তাকালেন, একটা ফোনকলেই তাঁর চোখমুখের ভাব পাল্টে গেছে। কিছুটা বিস্ময় এসে ভর করেছে তাঁর চোখেমুখে। সাধারণত পুলিশরা বিস্মিত হয় নাহ, তাঁদের এই অনুভূতিটা চাকরির দিন বৃদ্ধির সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের অনুভূতি থাকে তিনটা, রাগ, ক্রোধ এবং ভয়। তাই হঠাত ওসি সাহেবকে বিস্মিত হতে দেখে কিছুটা উপভোগই করছিলাম ব্যাপারটা।
নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, 'আমার ছেলের রক্ত লাগবে সেটা কিভাবে জানেন আপনি? আর ওর ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করার মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছি নাহ সেটাও বা কিভাবে বুঝলেন?'
পুলিশদের অন্য আরেকটা যে স্বভাব আমাকে খুব মজা দেয় সেটা হলো তাঁরা যে কোন সময় আপনি, তুমি, তুই নামক সম্বোধনগুলোর একটা হতে অন্যটায় চলে যেতে পারে।
- সেটা অনুমান করেছি। বাদ দিন সেই কথা। তা আপনার ছেলের জন্য ডোনার পেয়েছেন কি?
- হ্যাঁ পাওয়া গেছে, কিন্তু এখনো আরো দুই ব্যাগ লাগবে, কি যে করব বুঝতে পারছি নাহ।
হঠাত নিজের কথাগুলো আমার কাছে বলতে শুরু করাতে কিছুটা লজ্জিত বোধ করা শুরু করলেন আক্কাস সাহেব। 'আমার কথা বলা শুরু করে দিলাম অকারণে। আপনার কথা বলুন, ঠিক কি কারনে এরকম থানাতে আগমনের ইচ্ছা হলো আপনার? নিন, সিগারেট নিন।'
সিগারেট জ্বালিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ার আগ পর্যন্ত কিছুই বললাম নাহ, তাঁর উৎসুক দৃষ্টিকে সম্পূর্নরূপে উপেক্ষা করে গেলাম।
ধোঁয়া ছাড়ার পর বললাম, 'আসলে কোন কারন ছিল নাহ, অনেকদিন পর আজ ঘর হতে বের হয়েছিলাম, বাসাতে ফেরার পথে পেট্রোল ডিউটিতে থাকা পুলিশের গাড়ীটা দেখি। তখন মনে হলো, অনেকদিন থানার ভেতরে আসা হয় নাহ, তাই একটু ঘুরে আসি।'
কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ওসি সাহেব, তারপর বললেন, 'মন চায় আপনাকে নিয়ে ফুটবল খেলি। কিন্তু কেন জানি সেটা করতে পারছি নাহ। বিদায় হন সামনে থেকে। থানার আশেপাশে আপনাকে যেন আর না দেখি।'
থানার গাড়ীতে করে আধা রাস্তা যখন পার হলাম, তখন ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বলে পুনরায় হাটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে এলাকাতে পৌঁছে গেলাম একসময়।
রাস্তার কুকুরগুলো যেন এতক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই সাদা কুকুরটা কঠিন এক হাঁক ছাড়লো, সারা জীবনেও মনে হয় নাহ কুকুরটা এত জোরে ডাক দিয়েছে। এরপর হাঁক ছাড়লো কালো কুকুরটা, এরপর বাকি কুকুরগুলো একসাথে। অনেকটা অভ্যর্থনা জানবার মত করে। আমি ওদের ছেড়ে খানিক এগোতেই সাদা কুকুরটা পেছন পেছন আসতে লাগল। সাদা কুকুরটার পেছনে কালো কুকুরটা। কালো কুকুরটার পেছনে ওদের বাকি চ্যালাগুলো।
হুজুর টাইপ লোকটার বাসা যখন অতিক্রম করছিলাম, তখন দোতালা হতে হালকা কথা ভেসে আসতে লাগল, দুইটা পুরুষ কন্ঠের ফিসফাস। একজনের আর্তধ্বনি, অন্যজনের চরম পুলক প্রাপ্তির উল্লাস।
সেহরির সময় ডিসোফ্যান খাওয়াতে পরদিন পুরোটা সময় ধরে ঘুমালাম, খালি ইফতারের আগমুহূর্তে সেই বয়স্ক ভদ্রমহিলার একটানা ফোনে ঘুম ভাংগল। মহিলা নিজেকে এখন অনেকটাই শক্ত করে নিয়েছেন, আমাকে তাঁর পুত্রের মত শাসন করেন, আমিও বাঁধা প্রদান করি নাহ। কথা বলতে বলতে এক সময় তাঁর ছেলের ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখলাম। কেন নিলাম, জানি নাহ, কিন্তু মনে হলো নেয়া দরকার, তাই নিয়ে নিলাম।
রাতে আবার বের হলাম, কাব্য ছেলেটার কোন খবর নেই গোটা মাস ধরে, ওকে নিয়ে আমি বেশি একটা চিন্তাও করছি নাহ।
রাতে বের হয়েই আবার কুকুরগুলোর সাথে দেখা হয়ে গেল, আজকেও অনুসরণ করছে, তবে কিছুটা দূরত্ব রেখে। নিজেকে কুকুরদের নেতা ভাবতে কেমন যেন লাগছে।
হুজুর টাইপ লোকটার বাসা হতে আজও আগের রাতের মত একজনের চাপা আর্তনাদ এবং অন্যজনের উল্লাসধ্বনি ঠিকই শুনতে পেলাম। হঠাত কি মনে হতে ভদ্রমহিলার থেকে পাওয়া তাঁর ছেলের নাম্বারে ফোন দিয়ে বসলাম। তখন দোতালার চাঁপা শব্দ হওয়া ঘরটার উল্লাস করতে থাকা পুরুষকন্ঠটার কিছুটা বিরক্তময় গলা শুনতে পেলাম। 'এই সময় কোন হালায় ফোন দেয়...' ফোনটা কেটে দিয়ে পুনরায় সামনে হাঁটতে থাকি।
আগের রাতের সেই বিড়ি বিক্রেতাকে আজও পেয়ে গেলাম। বেটা যে আজকেও টাকা মারবে সেটা আগে থেকেই জানা থাকার পরও এক প্যাকেট লীফ দিতে বললাম। ঠিক তখন গতরাতের পেট্রোল গাড়ীটা সামনে এসে হাজির হলো। আজকেও আগের দিনের সেই দারোগা এগিয়ে আসছে।
- গাড়ীতে উঠুন, স্যারের নির্দেশ।
- (বিড়ি বিক্রেতাকে দেখিয়ে) ও আমার কাছে টাকা পায়, কিন্তু আমার কাছে কোন টাকা নেই। টাকার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এখান থেকে যেতে পারছি নাহ।
- তাহলে এই ব্যাটাকেও সাথে করে নিয়ে আসুন আমাদের সাথে।
বিক্রেতা ছেলেটা প্রচন্ড আকারের ভয় পেয়ে গেছে। সিগারেট প্রতি ২/৩ টাকা লাভের জন্য রাতে ব্যবসা করে সে, কিন্তু মনে হয় নাহ, আজকের পর আর কখনো রাতে বিক্রি করতে নামবে সে।
গাড়ী থানা যাবার রাস্তাতে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরল। আমি সিগারেটের প্যাকেট হতে একটা সিগারেট ধরালাম। বিক্রেতা ছেলেটা ইতিমধ্যেই ভয়ে কাপছে। কথা বলে জানতে পারলাম, ওর নাম আরিফ, বয়সে আমার চেয়ে ৩/৪ বছর ছোট হবে।
সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবছি ওসি সাহেব আমাদের জামাই আদর করতে ডাকলে থানাতেই নিয়ে যেত, কিন্তু তা না করে অন্য কোথাও যখন নিচ্ছে তখন এনকাউন্টার করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে নাহ।
পরদিন পত্রিকার শিরোনাম কি হতে পারে সেটা ভেবেই শিহরিত হয়ে উঠলাম। পুলিশের সাথে তুমুল বন্দুকযুদ্ধে কুখ্যাত সন্ত্রাসী নীল ও তাঁর এক চ্যালা নিহতঃ বিপুল পরিমাণে অস্ত্র উদ্ধার, আহত ১ জন পুলিশ।
কিন্তু সেটা বাস্তবে পরিণত হতে পারল নাহ, যখন গাড়ী থামার পর নেমে দেখি আমাদের একটা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।
আমি আরিফকে নিয়ে কেবিনে পৌছাতেই আমাদের দেখে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলেন শক্ত স্নায়ুর ওসি ও একজন বাবা আক্কাস সাহেব। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলেন, 'নীলদা, নিজের জানামতে কোন পাপ করি নাই সজ্ঞানে। তাহলে কিসের শাস্তি দিচ্ছে খোদা আমাকে? মাত্র এক ব্যাগ রক্ত দরকার, তাহলেই ডাক্তার অপারেশন শুরু করতে পারেন, কিন্তু আমি কি বাবা হয়ে আমার ছেলের দরকারের সময় এভাবেই চুপচাপ অথর্ব হয়ে থাকব?'
উত্তরে তাঁকে কিছুই বললাম নাহ। মানুষের আবেগ অনুভূতির খুব একটা দাম নেই আমার কাছে, কখনোই ছুঁয়ে যায় নাহ আমাকে।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা ৯/১০ বছরের বাচ্চা শীর্ণ দৃষ্টিতে তাঁর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। প্রথম যে জিনিসটা মাথায় আসল তখন, মহিলা এখনো কিভাবে শান্ত আছেন।
এগিয়ে গেলাম বেডের দিকে, পিচ্চিটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কি রে ব্যাটা,কেমন আছিস?'
'ভালোই তো আছি কাকু, কিন্তু দেখ না, বাবা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছে।'
'তোর অপারেশন করতে দেরি হলে কিছু হয়ে যায় কিনা, সেটার ভয় পাচ্ছে সে।'
'হুহ, আমার কোন কচুও হবে নাহ। বাবা বলেছে, তোমার নাকি সুপার পাওয়ার আছে, আমাকে ঠিক করে দিতে পারবে মুহূর্তেই, কি পারবে নাহ?'
আড়াআড়ি দৃষ্টি বিনিময় হলো আক্কাস সাহেবের সাথে, 'কেন পারব নাহ? অবশ্যই পারব। তাঁর আগে বল, অপারেশন থিয়েটারে নিলে ভয় পাবি না তোহ?'
'না কাকু, একদমই নাহ, কিন্তু তুমি একটু তাড়াতাড়ি করো, মাথায় খুব ব্যাথা করছে।'
আক্কাস সাহেবের দিকে তাকালাম, 'ডাক্তার ডাকুন, আরো এক ব্যাগ রক্ত দেবার লোক পেয়ে গেছেন।'
আমার কথা শুনে চোখের পানি মুছে ডাক্তার ডাকতে গেলেন আক্কাস সাহেব।
আরিফের দিকে তাকালাম, 'রক্ত দিতে পারবে তো?'
'কি যে কন আপনে? এত সুন্দর একটা পিচ্চিরে বাঁচাইতে নিজের জান দিবার পারুম।'
আরিফের ব্লাড টেস্ট করে দেখা গেল সেটা আক্কাস সাহেবের পিচ্চি ছেলে, অরিনের সাথে ম্যাচ করছে।
হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ। অরিন অপারেশন থিয়েটারে, আরিফও সেখানে, রক্ত দিতে। আমি আর আক্কাস সাহেব দুজনেই সিগারেট ধরালাম। হাসপাতাল বারান্দাতে থাকা অন্যান্য রোগীদের আত্মীয়ের কাছে এবং অন্য পুলিশদের কাছে সিগারেট বেচা শুরু করে দিলাম। লীফ ১০ টাকা, বেনসন ১৫ টাকা। কেউই না করছে নাহ বা প্রতিবাদ করছে নাহ।
মাঝে সময় করে আক্কাস সাহেবের ব্যাজে বি মাইনাস লেখার রহস্য জানতে চাইলাম। তিনি যখন বললেন ওটা তাঁর রক্তের গ্রুপ, কারো রক্তের প্রয়োজন হলে যাতে তাঁকে সহজেই খুঁজে পেতে পারে, তাই এমনটা করা।
আরিফকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম, অরিন এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকবে ৪৮ ঘন্টা। আসার সময় যে গাড়ীতে করে এসেছিলাম সেটাতে করেই ফিরে যাচ্ছি। হুজুরের চেহারা মতন লোকটার বাড়ির সামনে নামলাম আমরা। নামার পর এখনো চলে যাচ্ছি নাহ দেখে সেদিনের সেই দারোগা সাহেব আজ বিনীত গলাতে বলে উঠলেন, 'স্যারের কি এখানে বিশেষ কোন কাজ আছে? আমরা কি সাহায্য করতে পারি?'
'হ্যাঁ, কাজ আছে একটা, তবে কোন সাহায্য নেব নাহ আপনাদের থেকে। আপনারা চাইলে সেটা দেখতে পারেন, তবে গাড়ীটা একটু আড়ালে সরিয়ে নিন।'
দারোগা সরে যেতেই আরিফকে বলে উঠলাম, 'তোর মা যে এখনো তোকে খুঁজে ফিরে সেটা তুই জানিস?'
আমার কথা শুনতেই কিছুটা চমকে উঠল সে, 'আমার মায়ের কথা আপনি কিভাবে জানলেন ভাই?'
'জানি, সেটা কোন একভাবে, সেটা কথা নাহ। কথা হচ্ছে, মায়ের কথা মনে পড়ে?'
'হ্যাঁ, ভাই, খুব বেশিই মনে পড়ে। পকেটে টাকা না থাকায় বাড়ি যেতে পারি নাহ, এদিকে একদিন এক শালা ফোনটা চুরি করে নিয়ে গেছে দেখে মায়ের নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছি।' কাঁদতে কাঁদতে বলে ছেলেটা।
'কান্না থামা, না হলে মজা মিস করবি।'
ফোন দিলাম সেই নাম্বারটাতে, আবার দোতালার ঘর থেকে বিরক্তপূর্ণ স্বরে কেউ ধরল ফোনটা।
'এখুনি নীচে নামো, পুলিশ রেইড দিতে আসছে।' এটা বলে কেটে দিলাম। সাথে সাথে অনেকগুলো কর্কশকন্ঠ শুনতে পেলাম বাড়িটা থেকে। হুটোপুটি, লুটোপুটির শব্দও শুনতে পেলাম। হঠাত বাড়ির দরজা খুলে হুজুর টাইপ লোকটা বের হয়ে বাইরে কি অবস্থা সেটা দেখতে উকিঝুঁকি মারা শুরু করল। সে খালি রাস্তাতে দু'জন মানুষ এবং কয়েকটা কুকুর দেখল, যার ভেতর একটা কুকুর সাদা এবং একটা কালো কুকুরও আছে।
পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বের হবার সাথে সাথে সাদা কুকুরটাকে বললাম, 'ধর।'
আমার বলতে দেরি, কিন্তু নির্দেশ পাবার সাথে সাথে সবগুলো কুকুর ঝাপিয়ে পড়লো লোকটার উপর, পাঁচ মিনিটের ভেতর লোকটার গলা হতে কোন শব্দ আর পাওয়া গেল নাহ, গলার টুঁটি কামড়ে ছিড়ে নিয়েছে সাদা কুকুরটা। একপাশে পড়ে থাকা ফোন আর হাসপাতালে বিক্রি করা সিগারেটের সব টাকা ছেলেটার হাতে ধরিয়ে বললাম, 'কাল বাড়ি যাবি। মায়ের সাথে একমাস থাকবি, টাকার দরকার পড়লে সেটা ওসি সাহেব দেখবেন। আর ঠিক ফজরের আজানের পর তোর মাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে নিবি আগে।'
ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, যেই একটু কথা বলার চেষ্টা করছে, তখনই হেঁচকি উঠে সেটা জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের আবেগ এত বেশি কেন?
এতক্ষণ ধরে সব দেখতে থাকা পুলিশের গাড়ীটার কাছে যেয়ে বললাম, বাড়ীটার ভেতরে কি হয় সেটা আর নাই বললাম, কিন্তু সেখানে থাকা সবগুলো ছেলেকে আপনারা আজ উঠিয়ে নেবেন এবং ওদের আজকের ভেতরই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন।
পুলিশের গাড়ীটা বাড়ির দিকে, আরিফ রাস্তার উল্টোদিকে আর আমি কুকুরগুলোর সামনে থেকে বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আজ আর বাসাতে ফিরতে মন চাচ্ছে নাহ। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মনের সব কষ্টগুলো একসাথে বর্ষণ করবে আজ এই ধরাধামে। আমি হাঁটতে লাগলাম, গন্তব্যহীন, লাগামহীন।
হেডফোনে এলি গোল্ডিংয়ের বিটিং হার্ট হাই ভলিউমে ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চলেছি গতরাত থেকে বৃষ্টির ভেতর। শরীর এবং ফোন দুটোই ভিজে একাকার, কিন্তু কোন কিছুতে পাত্তা দিচ্ছি নাহ।
বাচ্চাদের মত হাসতে পারা মেয়েটা কাল থেকে অজস্রধারায় ফোন এবং টেক্সট বর্ষণ করে গেছে, কিন্তু ইচ্ছা করেই কোন রিপ্লাই দেই নি। সর্বশেষ টেক্সটটার অল্পাংশ চোখের দৃষ্টি আর এড়াতে পারল নাহ। "কাল থেকে ভিজছ, আর কতক্ষণ? আমিও তোহ ভিজে একাকার, সর্দিও এসেছে, ঠান্ডাও লেগেছে তো।"
টেক্সটটা দেখতেই সামনে এক অপরূপ মেয়ে এসে হাজির। 'অ্যাই বোকা ছেলে, তুমি বৃষ্টিতে ভিজলে তোমায় এত বেশি নিষ্পাপ লাগে কেন? চোখ ফেরাতে পারছি না তোহ। তুমি চাও বা না চাও নীলের নীলিমা কিন্তু আমি হবই, হুহ।'
আমি কিছুই না বলে শুধু আমার বিভ্রান্তিকর হাসিটা হাসি।
By: অভ্র নীল
Facebook: অভ্র নীল
রাস্তায় একটা সাদা কুকুর কিছুক্ষণ পরপরই ডেকে উঠছে, আর তখন ওর পিছনে থাকা কালো কুকুরটাও এদিক ওদিক সবদিক দৌড়ে তারস্বরে চিৎকার করছে।
একটানা অনেকদিন শরীর খারাপ থাকায় সূর্যের আলো গায়ে মাখার সুযোগ হয়নি, তাই আজ চাঁদের আলোতে স্নান করে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছি।
আমাকে দেখে মনে হয় সাদা কুকুরটার পছন্দ হয় নি। তাই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কয়েকবার ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
কুকুরদের ভাষা আমার জানা নেই, তবে আমার মনে হয় কুকুরটা আমার পরিচয় জানতে চেয়ে চিৎকার করছে। এখনো হয়তো বুঝে উঠতে পারছে নাহ আমি চোর না সাধু কোন গোছের। দাঁতমুখ খিঁচানোর হয়তো সেটাই কারন। সারমেয় ভাষাতে হয়তো বুঝিয়ে দিতে চাইছে এ এলাকাতে তাঁর উপর দাদাগিরি চলবে নাহ। পৈতৃক সূত্রে এলাকার নেতা না হলেও সে যে নিজেকে এই এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি ভাবে সেটা তাঁর হাবেভাবে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। অন্তত যাতে তাঁকে অনুসরণ করা কালো কুকুরটা আর তাঁর পেছনের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরগুলোকে তো তাঁর বুঝানো দরকার তাঁর ক্ষমতার ব্যপ্তি কত বিশাল পরিমাণের।
বাঘে ছুলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে বত্রিশ ঘা। সুন্দরবনের সব বাঘ এখন চিড়িয়াখানার খাঁচায়, না হলে ধানমন্ডি ২ এর নেতা খ্যাতা টাইপ লোকদের বাসাতে সোফার শোভাবর্ধন করছে। একবার খাঁচার ভেতরে থাকা এক বাঘকে মানুষের মাথা লাগিয়ে দাঁড়ি মোচসহ বিড়ি ফুঁকতে দেখেছিলাম। সময় তখন বর্ষাকাল, দর্শনার্থীর আনা গোনা ছিল নাহ, এরকম নির্জন অবস্থায় হঠাত আমাকে দেখতে পেয়ে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল। আমি খাঁচার বাইরে থাকলেও ঝেড়ে দৌড় লাগাই, কে জানে আমার কাছে যদি গাজার স্টিক আবদার করে বসে, তখন? তাই বাঘের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বাদ, বাবা পুলিশে চাকরি করে অবসর নিয়েছিলেন, তাই পুলিশের সাথেও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বাদ। তারপরও কোন নতুন কনস্টেবল হঠাত থানায় ধরে নিয়ে গেলে সেখান থেকে কিভাবে যেন ১০ মিনিটের ভেতর ছাড়া পেয়ে যাই। দুই তিনজনের ব্যাপারে ধারণা করতে পারি আমাকে ছাড়ার পেছনে ভূমিকা রাখার, কিন্তু কাজটা আসলে কে করে সে ব্যাপারে সঠিক অনুমান কখনো করে উঠতে পারি নি।
বাঘ, পুলিশ বাদ। দাঁড়িয়ে আছি কয়েকটা চ্যালা নিয়ে ঘিরে দাঁড়ানো নেতা টাইপ কুকুরটার সাথে। আমাকে সে তাঁর নিজস্ব ভাষাতে প্রশ্ন করেছে, উত্তর দিতে না পারলে আমাকে কামড়ে দেবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আচ্ছা, কুকুরে ছুলে কত ঘা?
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমিও বার কতক সারমেয় ভাষার মত করে ঘেউ ঘেউ করে উঠলাম। উত্তর সঠিক হয়েছে কিনা জানি নাহ, তবে সাদা কুকুরটাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কালো কুকুরসহ বাকি কুকুরগুলো সরে যেয়ে রাস্তা করে দিল হাঁটার। এই সুযোগ ঝটপট কেটে পড়ার, কেটে পড়ছিও প্রায়, এমন সময় আবার সেই কলিজা ঠান্ডা করা সারমেয় ধ্বনি।
দৌড় দেবার কথা মনে আসল একবার, কিন্তু সাথে সাথেই সেটা বাতিল করে দিলাম। এদের মনস্তত্ত্ব অনেকটা সাধারণ পাবলিকের মত। যাদের ধমক দিলে কুই কুই করে ওঠে, যেন এখুনি কেঁদে দিবে। কিন্তু যেই একবার বুঝবে আপনি চিপাতে, তখন মারা দিতে দিতে একেবারে ভরে দিবে।
মেজাজ খুব গরম হয়ে গেল, কিছু না বলে সিম্পল 'ইগনোর কর' নীতিতে হেঁটে যেতে থাকলাম। অন্য কুকুরগুলো একটা হেভিওয়েট চিৎকার যুদ্ধ দেখার জন্য অনেক আগ্রহ নিয়ে ওয়েট করলেও আমার রণে ক্ষণ দেয়া দেখে খুবই আশাহত হলো মনে হয়।
রোজার মাস, মুখের চুল দাঁড়ি শেভ না করায় আর প্রতিদিনের দাঁত ব্রাশটা আজ না কাল করে গড়িমসি করাতে চেহারা দেখে যে কারো মনে করার কথা আফ্রিকা থেকে আমার আগমন ঘটেছে। দিনের বেলা রাস্তায় বের হলে হঠাত করে কোন বাংগালীর মুখে সোহাহিলি বা বাওয়ালি ভাষার অভিবাদনও শুনে বসতে পারি। রোজার ঠিক আগে হাত কাঁটাটা খুব ভালোই ভোগাল এ কয়দিন। এখন হাতে ফাঁক হয়ে যাওয়া চামড়া জোড়া লেগে গেলেও খুব বড় একটা কাটা দাগের অস্তিত্ব ঠিকই রয়ে গেছে, মাঝে মাঝে হাতে টানও অনুভব করি।
কুকুরগুলো এখন ঠিক আমার পেছন পেছন দলবদ্ধ হয়ে হাঁটছে, সাদা কুকুরটা, তাঁর পেছনে কালো কুকুরটা, তাঁর পেছনে তাদের বাকি চ্যালা চামুন্ডারা। রাস্তাতে এখনো কিছু লোকের হালকা পাতলা আনাগোনা থাকায় তাঁরা এ দৃশ্য দেখে অবাক ও নির্বাক। আমি কোন প্রকার ভাবভংগির ধার না ধেরে চুপচাপ হেঁটে চলছি, পেছনে সারমেয়কুল। মাঝে এক হুজুর গোছের দাড়িওয়ালা টাইপ লোককে দেখে সাদা কুকুরটা চাঁপা গলাতে ঘড় ঘড় করে উঠল, হুজুর তৎক্ষণাৎ বাড়ির ভেতরে ঢুকে পগারপাড়।
কোন দিকেই কোন খেয়াল না রেখে কোন বিশাল ভাবুকের মত হাঁটছি, সংগে একপাল কুকুর।
এ ক'দিন বাসাতে বসে থাকাকালীন অবসরের সময় কাঁটাতে যখন ফেসবুকে লেখালেখি নিয়মিত করলাম, তখন এক মেয়ের সাথে পরিচয়।
একদিন হঠাত ফোনে আননোন নাম্বার হতে কল আসল, আমি আবার আননোন নাম্বার হতে আসা কলগুলো খুব আগ্রহের সাথে ধরি। একবার এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা তাঁর ছেলেকে ফোন দিতে যেয়ে আমাকে ভূলে ফোন দিয়েই শুরু করে দিয়েছেন, 'কালামানিক, বাবা আমার, সোনা আমার, কেমন আছোস তুই?'
আমিও তখন গলাতে খুব আবেগ ঢেলে জবাব দেই, 'মুই খুব ভালা আছুইন মা। তুই কিবা আছুত?'
আমার গলার স্বরে বা কাঁচা অভিনয়ে এক সময় তিনি যখন বুঝতে পারেন আমি তাঁর কালো মানিক বা ফুটবলার পেলে কোনটাই নাহ, তখন অভিসম্পাত করতে করতে ফোনটা কাটেন, আর আমি বেডে শুয়ে জানালার ওপাশটা ভালোমত দেখার চেষ্টা করি।
কিছুক্ষণ পর পুনরায় মহিলাটির ফোনকল ঠিকই আসে, তবে এবার সেখানে না থাকে আবেগ না থাকে রুক্ষতা। কাঁদ কাঁদ স্বরে বেদনার্ত গলায় আমাকে তিনি জানান, তাঁর পেলে নাকি এখন সত্যিই প্লেয়ার হয়ে গেছে। মার প্রতি তাঁর এখন আর কোন অনুভূতি কাজ করে নাহ, তাঁকে নাকি ইচ্ছামত গাল পেরে আর কখনো ফোন না করার ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে সে। মহিলা তখন আমার কাছ থেকে পাওয়া আবেগময় কথার সাথে তাঁর ছেলের কথার তুলনা করে আর হাহাকার করেন শুধু। আমি তখন কিছু না বলে চুপ করে ফোনটা কেটে দেই, কিছু কিছু সময় থাকে, যখন শান্তনার চেয়ে কেঁদে বুক ভাসালেই কষ্ট বেশি লাঘব হয়।
যথারীতি তাই সেদিনও ফোনটা রিসিভ করি, ওপাশ থেকে হ্যালো শুনতেই কিছুটা নিরাশ হলাম। মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চা মেয়ে খিল খিল করে হাসছে আর কথা বলছে।
- অ্যাই তুমি নীল?
- না, আমি ব্লু। কি চাই?
- হিহিহি, তোমার পাঞ্জাবীতে পকেট আছে?
- না, তবে প্যান্টে পকেট আছে, রেডিমেড প্যান্ট, পকেট থাকেই।
- তাইলে তুমি কিসের হিমু হইলা? হিমুদের তো পকেট থাকে নাহ।
- হলুদ হিমু হওয়া সহজ, কিন্তু নীল হিমু হওয়া কঠিন দেখে কেউ হতে চায় নাহ, কিন্তু আমি নীল হিমু।
- তাই নাকি? আচ্ছা, আমি যদি নীল হিমুর নীলিমা হতে চাই তাহলে কি করতে হবে আমায়?
- আপাতত বসে বসে মুড়ি খেলেই চলবে। আজান দিয়েছে, ইফতারী করছি, তুমিও করো।
- খাইছে, নেশাখোরদের যে ধর্মভীতি থাকে সেটা জানা ছিল নাহ।
- আজব, ধর্মভীতি আসবে কই থেকে, নেশাখোরদের রোজা রাখতে নিষেধ আছে নাকি?
- না তা নেই, কিন্তু আমার জানামতে নেশাখোর ছেলেদের ধর্মের প্রতি কোন আগ্রহ, ভয় কোনটাই থাকে নাহ।
- আমারও খুব একটা যে আগ্রহ বা ভয় আছে ধর্মের প্রতি তা নাহ। এটার আগমন মূলত বিশ্বাসের উপর থেকে।
- সে সাথে ভয়ও।
- ধর্মে ভয় দেখিয়ে ছাগল খেদানোর মত করে বোকাদের ধর্ম পালন করতে বাধ্য করা হয়, আর যার বুদ্ধিমান তাঁরা ধর্মটাকে আঁকড়ে ধরেন মূলত বিশ্বাসের উপর থেকে।
- ধূর তোমার সাথে কথায় পারা যাবে নাহ। শোন, এতকিছু বুঝি নাহ, এখন থেকে আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড। আমি যেটা বলব সেটাই সত্য বলে মেনে নিবা, না হলে চিমটি খাবা। আমার রাগ হলে রাগ ভাংগাবা, না হলে চিমটি খাবা। আমায় কাঁদালে চিমটি খাবা, বুঝতে পারছ?
- হু, বুঝছি, এখন থেকে ভাত না খেলেও চলবে আমার, তোমার চিমটি খেতে খেতেই পেট ভরে যাবে আমার।
- কি বললা? জোরে বলো, শুনি নাই।
- কিছু নাহ, আচ্ছা রাখছি এখন, পরে কথা হবে।
মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। ওর নামটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি, পরে একসময় জেনে নিতে হবে।
রাস্তায় কুকুরগুলো এখনো পিছু পিছু আসছে, আমিও হেঁটে চলেছি, উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন।
সিগারেট খাবার জন্য খুব মন খুব আনচান করলেও কোন চায়ের দোকান খোলা পেলাম নাহ। হয়তো রোজার মাস বলেই দোকানগুলি বন্ধ।
এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সাথে সাইকেল, সেটায় একটা ছোটখাট ব্যাগের মত কি যেন।
তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম, 'ভাই সিগারেট কই পাওয়া যায়?'
'কি সিগারেট?'
'গোল্ড লীফ, দুইটা হলেই হয়। আছে?'
সে তাঁর ব্যাগ হতে একটা লীফের প্যাকেট হতে দুটো গোল্ড লীফ বের করে দিল।
খুব খুশি মনে ব্যাটাকে বিশ টাকার একটা নোট দিতে সেটা নিজের পকেটে চালান করে দিল। বাকী দেবার কোন নাম গন্ধ নাই।
চাইতেই সে বলল, 'ভাই রাতের রেট এটা। আর লাগবে আপনার?'
আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম, পথে টহলরত এক পুলিশের গাড়ির সামনে পড়ে গেলাম।
- বাসা কই?
- যেখান থেকে আসছি।
- যান কই?
- বিড়ি খাইতে।
- ঐ রশিদ, এই হালারে একটু চেক কর তো, কথার ভাবভংগি ভালা লাগতেছে নাহ।
- চেক করার কি আছে, আমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে কিনা সেটা চেক করতে চাইছেন? শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন? আছে রে ভাই আছে, আমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে।
- আবে হালা কস কি? ঐ রশিদ ধর হালারে, নগদে হ্যান্ডকাফ লাগা, ঐ আবুল গাড়ি স্টার্ট দে।
- স্যার, হাতকড়া লাগানো লাগানো লাগবে নাহ, আমি নিজেই আপনাদের সাথে যাচ্ছি।
জেরারত দারোগাটি বিভ্রান্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কি করবেন বুঝতে পারছেন নাহ, আমি নিজে গাড়ীর ভেতরে উঠার সাথে সাথে আমাকে অনুসরণ করে গাড়ীতে উঠে বসলেন চুপচাপ।
থানায় পৌঁছার পরপরই ওসির রুমে তলব পড়ল আমার। ওসির গায়ে পুলিশের শার্ট, কিন্তু পড়নে লুংগি।
শার্টের ব্যাজে আক্কাস বি মাইনাস লেখা, কথাটার অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম নাহ।
মানুষ এখন পরীক্ষাতে এ প্লাস পেলেও সেটা কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করে নাহ, এ প্লাস এতটাই সস্তা।
সেখানে এই লোক ব্যাজে নামের পাশে বি মাইনাস ঝুলিয়ে রেখেছে কোন আক্কেলে? সে সারজীবন পরীক্ষাতে বি মাইনাস পেয়েও এখন থানার ওসি এটা মানুষকে দেখাতে? মাথায় তাঁর টাক চকচক না করলেও সেখানে চুলের অভাব দেখতে পাচ্ছি। যেসব ওসির মাথায় চুল কম থাকে, তাঁরা ভীষণ বদরাগী হয়ে থাকে শুনেছি। আক্কাস সাহেবের মুখে আক্কাস বিড়ি না থাকলেও একটা গোল্ড লীফ সাঁই সাঁই করে জ্বলছে। বিড়ির সাথে সাথে তাঁর মুখে একটা হাসির ধারাও দেখতে পাচ্ছি। মনে হয় এই লোক সবসময় মুখে হাসি ধরে রাখা টাইপ পাবলিক। দেখা গেল কেউ এসে তাঁকে জানাল যে তাঁর ছেলে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, তখন তিনি মুখের হাসি হাসি ভাবটা ধরে রেখেই হয়ত তাঁর স্ত্রীকে বলবেন, 'এই শোন, খোকা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমি বের হয়েছি, তুমি কোন চিন্তা করো নাহ কেমন?' অন্যদিকে কর্তব্যরত অধস্তনকে ডেকে হাসি হাসি মুখে বলবেন, 'রফিক সাহেব, ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমি একটু বের হলাম, আপনি এদিকটা দেখে রাখবেন।' রফিক সাহেবের মাথায় কথাগুলো পুরোপুরি কাজ করার পূর্বেই হয়ত তিনি বের হয়ে গেছেন ততক্ষণে।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি সিগারেটের ফাঁক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো মুখে হাসি হাসি ভাবটা বহাল আছে,
- নাম?
- নীল।
- কি কর?
- পড়ি আর হাঁটি।
- এই দুইটা কাজ একসাথে করা যায় নাকি?
- জি স্যার, ট্রাই করে দেখবেন একবার, খুব বেশি মজা পাবেন পড়ে।
- হুম, কি কারনে থানায় আনা হইছে তোমাকে?
- কেন স্যার, কারন ছাড়া এখানে আসা কি বাড়ন?
- প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে কর কেন?
- আপনি এমন প্রশ্ন করতেছেন যা তাঁর উত্তর প্রশ্ন দিয়েই সঠিকভাবে দেয়া যায়।
-হুম, চা, বিড়ি, গাজা, অভ্যাস আছে?
- অভ্যাস না থাকলেও অনভ্যস্ত নই, তবে রোজার মাস বলে শুধু চা আর সিগারেটেই চলবে আমার।
- আচ্ছা, তুমি বসো আমি আসতেছি একটু।
আমার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়েই পাশের রুমে যেয়ে আমাকে যিনি ধরেছিলেন, সেই দারোগাকে ডাক দিলেন তিনি।
তাঁর সাথে কতক্ষণ চাঁপাস্বরে কথা বলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ তর্জন গর্জন করে চললেন, অতঃপর ফিরে আসলেন ধীরে ধীরে।
- তোমার কাছে যন্ত্রপাতি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই স্বীকার করতে গেলে কেন?
নাও তো করতে পারতে।
- মিথ্যা বলা আমার স্বভাবে নেই।
- ও আচ্ছা, তা শুনি তোমার যন্ত্রপাতির বিবরণ।
- স্যার কি সত্যিই শুনতে আগ্রহী?
- হ্যাঁ, বলতে থাকো।
- এটি দেখতে ঘন কালো, আপনি রয়েল ব্ল্যাক বলেও অভিহিত করতে পারেন। আশেপাশে কখনো চুল থাকে, কখনো থাকে নাহ। খুবই স্পর্শকাতর, তাঁর মানে এই নাহ যে স্পর্শে কাতুকুতু লাগার মত অনুভূতি হয়, বরং তখন সগর্জনে রেগে মেগে ফুঁসে ওঠে।
- হয়েছে হয়েছে থাক আর বলতে হবে নাহ। ফাজিল পোলা, ফাইজলামী করো পুলিশের সাথে? কানের নিচে একটা বয়রা খাইলে পুরা সিধা হয়ে যাবা বজ্জাত ছেলে কোথাকার।
- স্যার, আপনার আগের ওসিও একই কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে পোস্টিং নিয়ে নিজ ইচ্ছাতে বান্দরবান চলে গিয়েছিলেন।
- তবে রে হারামজাদা।
হাসি হাসি মুখটা হঠাত করে বদলে গেল, টেবিলের উপর হতে লাফিয়ে আমাকে চড়ানোর একটা প্রবণতা দেখা গেল আক্কাস সাহেবের ভেতর। ঠিক তখনই একটা ফোন আসল ওসি সাহেবের অফিশিয়াল টেলিফোনে।
ফোনটা বেজেই চলছে ক্রমাগত। আমাকে চড়াবেন নাকি ফোনটা ধরবেন সেটা নিয়ে কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্ত তিনি। সময় খুব খারাপ যাচ্ছে, কার না কার ফোন সেটা না ধরে কোন অহেতুক ভোগান্তিতে হয়তো পড়তে চান নাহ।
তাঁকে দ্বিধা হতে মুক্তি দিতে বলে উঠলাম, 'স্যার ফোনটা ধরুন, হয়তো আপনার ছেলের রক্তের গ্রুপের সাথে ম্যাচ করে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেছে।'
কথাটা শোনার সাথে সাথেই চমকে উঠলেন তিনি, টেলিফোনটা উঠালেন, তাঁকে শুধু হ্যালো বলতে শুনলাম, এরপর কতক্ষণ তিনি হু হা করে গেলেন। ডায়ালটা নামানোর পর শুধু অস্ফুটে গলাতে এটুকুই বলতে শুনলাম, 'ফাক।'
আমার দিকে তাকালেন, একটা ফোনকলেই তাঁর চোখমুখের ভাব পাল্টে গেছে। কিছুটা বিস্ময় এসে ভর করেছে তাঁর চোখেমুখে। সাধারণত পুলিশরা বিস্মিত হয় নাহ, তাঁদের এই অনুভূতিটা চাকরির দিন বৃদ্ধির সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের অনুভূতি থাকে তিনটা, রাগ, ক্রোধ এবং ভয়। তাই হঠাত ওসি সাহেবকে বিস্মিত হতে দেখে কিছুটা উপভোগই করছিলাম ব্যাপারটা।
নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, 'আমার ছেলের রক্ত লাগবে সেটা কিভাবে জানেন আপনি? আর ওর ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করার মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছি নাহ সেটাও বা কিভাবে বুঝলেন?'
পুলিশদের অন্য আরেকটা যে স্বভাব আমাকে খুব মজা দেয় সেটা হলো তাঁরা যে কোন সময় আপনি, তুমি, তুই নামক সম্বোধনগুলোর একটা হতে অন্যটায় চলে যেতে পারে।
- সেটা অনুমান করেছি। বাদ দিন সেই কথা। তা আপনার ছেলের জন্য ডোনার পেয়েছেন কি?
- হ্যাঁ পাওয়া গেছে, কিন্তু এখনো আরো দুই ব্যাগ লাগবে, কি যে করব বুঝতে পারছি নাহ।
হঠাত নিজের কথাগুলো আমার কাছে বলতে শুরু করাতে কিছুটা লজ্জিত বোধ করা শুরু করলেন আক্কাস সাহেব। 'আমার কথা বলা শুরু করে দিলাম অকারণে। আপনার কথা বলুন, ঠিক কি কারনে এরকম থানাতে আগমনের ইচ্ছা হলো আপনার? নিন, সিগারেট নিন।'
সিগারেট জ্বালিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ার আগ পর্যন্ত কিছুই বললাম নাহ, তাঁর উৎসুক দৃষ্টিকে সম্পূর্নরূপে উপেক্ষা করে গেলাম।
ধোঁয়া ছাড়ার পর বললাম, 'আসলে কোন কারন ছিল নাহ, অনেকদিন পর আজ ঘর হতে বের হয়েছিলাম, বাসাতে ফেরার পথে পেট্রোল ডিউটিতে থাকা পুলিশের গাড়ীটা দেখি। তখন মনে হলো, অনেকদিন থানার ভেতরে আসা হয় নাহ, তাই একটু ঘুরে আসি।'
কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ওসি সাহেব, তারপর বললেন, 'মন চায় আপনাকে নিয়ে ফুটবল খেলি। কিন্তু কেন জানি সেটা করতে পারছি নাহ। বিদায় হন সামনে থেকে। থানার আশেপাশে আপনাকে যেন আর না দেখি।'
থানার গাড়ীতে করে আধা রাস্তা যখন পার হলাম, তখন ড্রাইভারকে গাড়ী থামাতে বলে পুনরায় হাটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে এলাকাতে পৌঁছে গেলাম একসময়।
রাস্তার কুকুরগুলো যেন এতক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই সাদা কুকুরটা কঠিন এক হাঁক ছাড়লো, সারা জীবনেও মনে হয় নাহ কুকুরটা এত জোরে ডাক দিয়েছে। এরপর হাঁক ছাড়লো কালো কুকুরটা, এরপর বাকি কুকুরগুলো একসাথে। অনেকটা অভ্যর্থনা জানবার মত করে। আমি ওদের ছেড়ে খানিক এগোতেই সাদা কুকুরটা পেছন পেছন আসতে লাগল। সাদা কুকুরটার পেছনে কালো কুকুরটা। কালো কুকুরটার পেছনে ওদের বাকি চ্যালাগুলো।
হুজুর টাইপ লোকটার বাসা যখন অতিক্রম করছিলাম, তখন দোতালা হতে হালকা কথা ভেসে আসতে লাগল, দুইটা পুরুষ কন্ঠের ফিসফাস। একজনের আর্তধ্বনি, অন্যজনের চরম পুলক প্রাপ্তির উল্লাস।
সেহরির সময় ডিসোফ্যান খাওয়াতে পরদিন পুরোটা সময় ধরে ঘুমালাম, খালি ইফতারের আগমুহূর্তে সেই বয়স্ক ভদ্রমহিলার একটানা ফোনে ঘুম ভাংগল। মহিলা নিজেকে এখন অনেকটাই শক্ত করে নিয়েছেন, আমাকে তাঁর পুত্রের মত শাসন করেন, আমিও বাঁধা প্রদান করি নাহ। কথা বলতে বলতে এক সময় তাঁর ছেলের ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখলাম। কেন নিলাম, জানি নাহ, কিন্তু মনে হলো নেয়া দরকার, তাই নিয়ে নিলাম।
রাতে আবার বের হলাম, কাব্য ছেলেটার কোন খবর নেই গোটা মাস ধরে, ওকে নিয়ে আমি বেশি একটা চিন্তাও করছি নাহ।
রাতে বের হয়েই আবার কুকুরগুলোর সাথে দেখা হয়ে গেল, আজকেও অনুসরণ করছে, তবে কিছুটা দূরত্ব রেখে। নিজেকে কুকুরদের নেতা ভাবতে কেমন যেন লাগছে।
হুজুর টাইপ লোকটার বাসা হতে আজও আগের রাতের মত একজনের চাপা আর্তনাদ এবং অন্যজনের উল্লাসধ্বনি ঠিকই শুনতে পেলাম। হঠাত কি মনে হতে ভদ্রমহিলার থেকে পাওয়া তাঁর ছেলের নাম্বারে ফোন দিয়ে বসলাম। তখন দোতালার চাঁপা শব্দ হওয়া ঘরটার উল্লাস করতে থাকা পুরুষকন্ঠটার কিছুটা বিরক্তময় গলা শুনতে পেলাম। 'এই সময় কোন হালায় ফোন দেয়...' ফোনটা কেটে দিয়ে পুনরায় সামনে হাঁটতে থাকি।
আগের রাতের সেই বিড়ি বিক্রেতাকে আজও পেয়ে গেলাম। বেটা যে আজকেও টাকা মারবে সেটা আগে থেকেই জানা থাকার পরও এক প্যাকেট লীফ দিতে বললাম। ঠিক তখন গতরাতের পেট্রোল গাড়ীটা সামনে এসে হাজির হলো। আজকেও আগের দিনের সেই দারোগা এগিয়ে আসছে।
- গাড়ীতে উঠুন, স্যারের নির্দেশ।
- (বিড়ি বিক্রেতাকে দেখিয়ে) ও আমার কাছে টাকা পায়, কিন্তু আমার কাছে কোন টাকা নেই। টাকার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এখান থেকে যেতে পারছি নাহ।
- তাহলে এই ব্যাটাকেও সাথে করে নিয়ে আসুন আমাদের সাথে।
বিক্রেতা ছেলেটা প্রচন্ড আকারের ভয় পেয়ে গেছে। সিগারেট প্রতি ২/৩ টাকা লাভের জন্য রাতে ব্যবসা করে সে, কিন্তু মনে হয় নাহ, আজকের পর আর কখনো রাতে বিক্রি করতে নামবে সে।
গাড়ী থানা যাবার রাস্তাতে না যেয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরল। আমি সিগারেটের প্যাকেট হতে একটা সিগারেট ধরালাম। বিক্রেতা ছেলেটা ইতিমধ্যেই ভয়ে কাপছে। কথা বলে জানতে পারলাম, ওর নাম আরিফ, বয়সে আমার চেয়ে ৩/৪ বছর ছোট হবে।
সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবছি ওসি সাহেব আমাদের জামাই আদর করতে ডাকলে থানাতেই নিয়ে যেত, কিন্তু তা না করে অন্য কোথাও যখন নিচ্ছে তখন এনকাউন্টার করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে নাহ।
পরদিন পত্রিকার শিরোনাম কি হতে পারে সেটা ভেবেই শিহরিত হয়ে উঠলাম। পুলিশের সাথে তুমুল বন্দুকযুদ্ধে কুখ্যাত সন্ত্রাসী নীল ও তাঁর এক চ্যালা নিহতঃ বিপুল পরিমাণে অস্ত্র উদ্ধার, আহত ১ জন পুলিশ।
কিন্তু সেটা বাস্তবে পরিণত হতে পারল নাহ, যখন গাড়ী থামার পর নেমে দেখি আমাদের একটা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।
আমি আরিফকে নিয়ে কেবিনে পৌছাতেই আমাদের দেখে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলেন শক্ত স্নায়ুর ওসি ও একজন বাবা আক্কাস সাহেব। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলেন, 'নীলদা, নিজের জানামতে কোন পাপ করি নাই সজ্ঞানে। তাহলে কিসের শাস্তি দিচ্ছে খোদা আমাকে? মাত্র এক ব্যাগ রক্ত দরকার, তাহলেই ডাক্তার অপারেশন শুরু করতে পারেন, কিন্তু আমি কি বাবা হয়ে আমার ছেলের দরকারের সময় এভাবেই চুপচাপ অথর্ব হয়ে থাকব?'
উত্তরে তাঁকে কিছুই বললাম নাহ। মানুষের আবেগ অনুভূতির খুব একটা দাম নেই আমার কাছে, কখনোই ছুঁয়ে যায় নাহ আমাকে।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা ৯/১০ বছরের বাচ্চা শীর্ণ দৃষ্টিতে তাঁর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। প্রথম যে জিনিসটা মাথায় আসল তখন, মহিলা এখনো কিভাবে শান্ত আছেন।
এগিয়ে গেলাম বেডের দিকে, পিচ্চিটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কি রে ব্যাটা,কেমন আছিস?'
'ভালোই তো আছি কাকু, কিন্তু দেখ না, বাবা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছে।'
'তোর অপারেশন করতে দেরি হলে কিছু হয়ে যায় কিনা, সেটার ভয় পাচ্ছে সে।'
'হুহ, আমার কোন কচুও হবে নাহ। বাবা বলেছে, তোমার নাকি সুপার পাওয়ার আছে, আমাকে ঠিক করে দিতে পারবে মুহূর্তেই, কি পারবে নাহ?'
আড়াআড়ি দৃষ্টি বিনিময় হলো আক্কাস সাহেবের সাথে, 'কেন পারব নাহ? অবশ্যই পারব। তাঁর আগে বল, অপারেশন থিয়েটারে নিলে ভয় পাবি না তোহ?'
'না কাকু, একদমই নাহ, কিন্তু তুমি একটু তাড়াতাড়ি করো, মাথায় খুব ব্যাথা করছে।'
আক্কাস সাহেবের দিকে তাকালাম, 'ডাক্তার ডাকুন, আরো এক ব্যাগ রক্ত দেবার লোক পেয়ে গেছেন।'
আমার কথা শুনে চোখের পানি মুছে ডাক্তার ডাকতে গেলেন আক্কাস সাহেব।
আরিফের দিকে তাকালাম, 'রক্ত দিতে পারবে তো?'
'কি যে কন আপনে? এত সুন্দর একটা পিচ্চিরে বাঁচাইতে নিজের জান দিবার পারুম।'
আরিফের ব্লাড টেস্ট করে দেখা গেল সেটা আক্কাস সাহেবের পিচ্চি ছেলে, অরিনের সাথে ম্যাচ করছে।
হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ। অরিন অপারেশন থিয়েটারে, আরিফও সেখানে, রক্ত দিতে। আমি আর আক্কাস সাহেব দুজনেই সিগারেট ধরালাম। হাসপাতাল বারান্দাতে থাকা অন্যান্য রোগীদের আত্মীয়ের কাছে এবং অন্য পুলিশদের কাছে সিগারেট বেচা শুরু করে দিলাম। লীফ ১০ টাকা, বেনসন ১৫ টাকা। কেউই না করছে নাহ বা প্রতিবাদ করছে নাহ।
মাঝে সময় করে আক্কাস সাহেবের ব্যাজে বি মাইনাস লেখার রহস্য জানতে চাইলাম। তিনি যখন বললেন ওটা তাঁর রক্তের গ্রুপ, কারো রক্তের প্রয়োজন হলে যাতে তাঁকে সহজেই খুঁজে পেতে পারে, তাই এমনটা করা।
আরিফকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম, অরিন এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকবে ৪৮ ঘন্টা। আসার সময় যে গাড়ীতে করে এসেছিলাম সেটাতে করেই ফিরে যাচ্ছি। হুজুরের চেহারা মতন লোকটার বাড়ির সামনে নামলাম আমরা। নামার পর এখনো চলে যাচ্ছি নাহ দেখে সেদিনের সেই দারোগা সাহেব আজ বিনীত গলাতে বলে উঠলেন, 'স্যারের কি এখানে বিশেষ কোন কাজ আছে? আমরা কি সাহায্য করতে পারি?'
'হ্যাঁ, কাজ আছে একটা, তবে কোন সাহায্য নেব নাহ আপনাদের থেকে। আপনারা চাইলে সেটা দেখতে পারেন, তবে গাড়ীটা একটু আড়ালে সরিয়ে নিন।'
দারোগা সরে যেতেই আরিফকে বলে উঠলাম, 'তোর মা যে এখনো তোকে খুঁজে ফিরে সেটা তুই জানিস?'
আমার কথা শুনতেই কিছুটা চমকে উঠল সে, 'আমার মায়ের কথা আপনি কিভাবে জানলেন ভাই?'
'জানি, সেটা কোন একভাবে, সেটা কথা নাহ। কথা হচ্ছে, মায়ের কথা মনে পড়ে?'
'হ্যাঁ, ভাই, খুব বেশিই মনে পড়ে। পকেটে টাকা না থাকায় বাড়ি যেতে পারি নাহ, এদিকে একদিন এক শালা ফোনটা চুরি করে নিয়ে গেছে দেখে মায়ের নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছি।' কাঁদতে কাঁদতে বলে ছেলেটা।
'কান্না থামা, না হলে মজা মিস করবি।'
ফোন দিলাম সেই নাম্বারটাতে, আবার দোতালার ঘর থেকে বিরক্তপূর্ণ স্বরে কেউ ধরল ফোনটা।
'এখুনি নীচে নামো, পুলিশ রেইড দিতে আসছে।' এটা বলে কেটে দিলাম। সাথে সাথে অনেকগুলো কর্কশকন্ঠ শুনতে পেলাম বাড়িটা থেকে। হুটোপুটি, লুটোপুটির শব্দও শুনতে পেলাম। হঠাত বাড়ির দরজা খুলে হুজুর টাইপ লোকটা বের হয়ে বাইরে কি অবস্থা সেটা দেখতে উকিঝুঁকি মারা শুরু করল। সে খালি রাস্তাতে দু'জন মানুষ এবং কয়েকটা কুকুর দেখল, যার ভেতর একটা কুকুর সাদা এবং একটা কালো কুকুরও আছে।
পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে বের হবার সাথে সাথে সাদা কুকুরটাকে বললাম, 'ধর।'
আমার বলতে দেরি, কিন্তু নির্দেশ পাবার সাথে সাথে সবগুলো কুকুর ঝাপিয়ে পড়লো লোকটার উপর, পাঁচ মিনিটের ভেতর লোকটার গলা হতে কোন শব্দ আর পাওয়া গেল নাহ, গলার টুঁটি কামড়ে ছিড়ে নিয়েছে সাদা কুকুরটা। একপাশে পড়ে থাকা ফোন আর হাসপাতালে বিক্রি করা সিগারেটের সব টাকা ছেলেটার হাতে ধরিয়ে বললাম, 'কাল বাড়ি যাবি। মায়ের সাথে একমাস থাকবি, টাকার দরকার পড়লে সেটা ওসি সাহেব দেখবেন। আর ঠিক ফজরের আজানের পর তোর মাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে নিবি আগে।'
ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, যেই একটু কথা বলার চেষ্টা করছে, তখনই হেঁচকি উঠে সেটা জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের আবেগ এত বেশি কেন?
এতক্ষণ ধরে সব দেখতে থাকা পুলিশের গাড়ীটার কাছে যেয়ে বললাম, বাড়ীটার ভেতরে কি হয় সেটা আর নাই বললাম, কিন্তু সেখানে থাকা সবগুলো ছেলেকে আপনারা আজ উঠিয়ে নেবেন এবং ওদের আজকের ভেতরই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন।
পুলিশের গাড়ীটা বাড়ির দিকে, আরিফ রাস্তার উল্টোদিকে আর আমি কুকুরগুলোর সামনে থেকে বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আজ আর বাসাতে ফিরতে মন চাচ্ছে নাহ। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মনের সব কষ্টগুলো একসাথে বর্ষণ করবে আজ এই ধরাধামে। আমি হাঁটতে লাগলাম, গন্তব্যহীন, লাগামহীন।
হেডফোনে এলি গোল্ডিংয়ের বিটিং হার্ট হাই ভলিউমে ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চলেছি গতরাত থেকে বৃষ্টির ভেতর। শরীর এবং ফোন দুটোই ভিজে একাকার, কিন্তু কোন কিছুতে পাত্তা দিচ্ছি নাহ।
বাচ্চাদের মত হাসতে পারা মেয়েটা কাল থেকে অজস্রধারায় ফোন এবং টেক্সট বর্ষণ করে গেছে, কিন্তু ইচ্ছা করেই কোন রিপ্লাই দেই নি। সর্বশেষ টেক্সটটার অল্পাংশ চোখের দৃষ্টি আর এড়াতে পারল নাহ। "কাল থেকে ভিজছ, আর কতক্ষণ? আমিও তোহ ভিজে একাকার, সর্দিও এসেছে, ঠান্ডাও লেগেছে তো।"
টেক্সটটা দেখতেই সামনে এক অপরূপ মেয়ে এসে হাজির। 'অ্যাই বোকা ছেলে, তুমি বৃষ্টিতে ভিজলে তোমায় এত বেশি নিষ্পাপ লাগে কেন? চোখ ফেরাতে পারছি না তোহ। তুমি চাও বা না চাও নীলের নীলিমা কিন্তু আমি হবই, হুহ।'
আমি কিছুই না বলে শুধু আমার বিভ্রান্তিকর হাসিটা হাসি।
By: অভ্র নীল
Facebook: অভ্র নীল